শূর আফগান ও মুঘল আমলে বাংলার ইতিহাস

আফগান ও মুঘল সংঘর্ষ

  • হুসেনশাহী যুগের শেষদিক থেকেই মুঘল সম্রাট বাবর ও তাঁর পুত্র হুমায়ুন চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে মুঘল অধিকারে নিয়ে আসতে। কিন্তু আফগানদের কারণে মুঘলদের এই উদ্দেশ্য প্রথম দিকে সফল হয়নি। আফগান নেতা শের খান শূরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সম্রাট হুমায়ুন।
  • শের খান ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে দু’বার বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন।
  • তখন হুমায়ুন অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শের খানের পিছু ধাওয়া করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করে নেন।
  • গৌড়ের চমৎকার প্রাসাদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন এর নামকরণ করেন ‘জান্নাতবাদ’।
  • দিল্লি থেকে খবর আসে হুমায়ুনের সৎভাই হিন্দাল সিংহাসন দখল করার ষড়যন্ত্র করছেন।
  • এ খবর পেয়ে হুমায়ুন দিল্লির দিকে যাত্রা করলে শের খান চৌসা নামক স্থানে হুমায়ুনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অপ্রস্তুত হুমায়ুন পরাজিত হন (১৫৩৯ খ্রিঃ)।
  • মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের খান ‘শের শাহ’ উপাধি নেন।
  • ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনকর্তা আলী কুলিকে পরাজিত করে তিনি বাংলা দখল করেন। এ বছরই তিনি হুমায়ুনকে কনৌজের নিকট বিলগ্রামের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করেন। এভাবে দীর্ঘদিন পর বাংলা আবার দিল্লির শাসনে চলে আসে। শের শাহ শূর বংশের বলে এ সময়ের বাংলার শাসন ছিল শূর আফগান বংশের শাসন।

খিজির খান সুরক(১৫৩৯-১৫৪১ খ্রিস্টাব্দ)

  • শের শাহ আলী কুলিকে হত্যা করে খিজির খান সুরককে গৌড়ের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন।
  • তিনি সুলতান গিয়াস উদ্দীন মাহমুদ শাহের কন্যাকে বিয়ে করেন এবং বাংলার স্বাধীন সুলতানদের রীতি অনুকরণে টোকী বা বামখানা তথা উঁচু মঞ্চে বসতে শুরু করেন।
  • বিপদ অনুধাবন করে শের শাহ নিজে বাংলায় আসেন এবং খিজির খানকে সরিয়ে দেন।

কাজী ফজিলত(১৫৪১-১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ)

  • শের শাহ খিজির খানকে সরিয়ে দিয়ে বাংলাকে একক কোন গভর্নরের অধীন না রেখে অনেকগুলো প্রশাসনিক এককে বিভক্ত করে সেসবে একই পদমর্যাদার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এদের সকলের সমন্বয়ক এবং ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজী ফজিলত নামের একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিকে নিয়োগ করেন শের শাহ।
  • ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শের শাহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কাজি ফজিলতের শাসনের অবসান হয়।

মোহাম্মদ খাঁন সূর(১৫৪৫-১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ)

  • শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ‘ইসলাম শাহ’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং মোহাম্মদ খাঁন সূরকে বাংলার শাসক নিযুক্ত করেন।
  • ইসলাম খানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার আফগান শাসক মুহম্মদ খান সূর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। উপাধি ধারণ করেন ‘মুহম্মদ শাহ শূর’।
  • এই সময় শের খানের ভাগ্নে মুবারিজ খান ফিরুজ খানকে হত্যা করে ‘মুহম্মদ আদিল’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন।
  • মুহম্মদ শাহ সূর উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে জৌনপুর জয় করে আগ্রার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু মুহম্মদ আদিল শাহ সূরের কাছে পরাজিত ও নিহত হন।

শাহবাজ খান(১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ)

  • মুহম্মদ শাহ সূর নিহত হলে দিল্লির বাদশাহ আদিল শাহ শাহবাজ খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
  • তিনি মুহম্মদ শাহের পুত্র খিজির খানের কাছে পরাজিত ও সিংহাসনচ্যুত হন।

খিজির খান(১৫৫৫-১৫৬১ খ্রিস্টাব্দ)

  • মুহম্মদ শাহের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পুত্র খিজির খান ‘গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ’ উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন। কিছুদিন পর তিনি শাহবাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন।
  • তাঁর সময় শের শাহের বংশধরদের দুর্বলতার সুযোগে মুঘলী বাদশাহ হুয়ায়ূন দিল্লী পুনরুদ্ধার করেন।
  • হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আকবর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১৫৫৬ খ্রিঃ) আদিল শাহের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত ও নিহত করেন।
  • এতে আদিল শাহ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি বাংলার দিকে পলায়ন করলেন। পথিমধ্যে সুরজগড়ের নিকটবর্তী ফতেহপুরে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ কর্তৃক এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন (১৫৫৭ খ্রিঃ)।
  • গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হলে মুঘল সেনাপতি খান-ই-জামান তাঁর গতিরোধ করেন। কূটকুশলী বাহাদুর শাহ খান-ই-জামানের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন।
  • ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

গিয়াসউদ্দীন জালাল শাহ(১৫৬১-১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দ)

  • গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা গিয়াসউদ্দীন জালাল শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
  • ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তাঁর একমাত্র পুত্র বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাঁর নাম জানা যায়নি। মাত্র সাত মাস রাজত্ব করার পর তৃতীয় গিয়াসউদ্দীন নামে জনৈক আফগান দলনেতা তাঁকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন।
  • কিন্তু তিনিও বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। কররাণী বংশের রাজা তাজ খান কররাণী গিয়াসউদ্দীনকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

তাজ খান কররাণী

  • তাজ খান কররাণী ও সুলায়মান খান কররাণী শের শাহের সেনাপতি ছিলেন।
  • কনৌজের যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শের শাহ তাদেরকে দক্ষিণ বিহারে জায়গীর প্রদান করেন।
  • ইসলাম শাহের রাজত্বকালে তাজ খান কররাণী সেনাপতি ও কূটনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
  • ইসলাম শাহের বালকপুত্র ও উত্তরাধিকারী ফিরুযের সময় তাজ খান উজির নিযুক্ত হন।
  • ফিরুযকে হত্যা করে তাঁর মাতুল মুহম্মদ আদিল সূর সিংহাসনে বসেন। এ সময় তাজ খান কররাণী পালিয়ে গিয়ে ভ্রাতাদের সহায়তায় দক্ষিণ বিহারে প্রাধান্য স্থাপন করেন।
  • ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাজ খান কররাণী নামমাত্র বাংলার সুলতান বাহাদুর শাহ শূরের বশ্যতা স্বীকার করেন। কিছুদিন পর তিনি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হয়ে পড়েন।
  • অজ্ঞাতনামা গিয়াসউদ্দীন যখন শূর বংশের সিংহাসন দখল করেন তখন সুযোগ বুঝে তাজ খান ও তাঁর ভ্রাতারা গিয়াসউদ্দীনকে পরাজিত ও নিহত করে গৌড় দখল করেন।
  • তাজ খান কররাণীর মৃত্যুর পর ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভাই সুলায়মান খান কররাণী বাংলার সুলতান হন।
  • সুলায়মান কররাণীর বিজ্ঞ উজির লোদী খানের পরামর্শে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলছিলেন।
  • ১৫৭২ খিস্টাব্দে সুলায়মান কররাণীর মৃত্যু হলে পুত্র বায়জিদ সিংহাসনে বসেন।
  • কিন্তু অল্পকাল পরেই এ অত্যাচারী সুলতানকে হত্যা করেন আফগান সর্দাররা। এবার সিংহাসনে বসেন সুলায়মান কররাণীর দ্বিতীয় পুত্র দাউদ কররাণী।
  • তিনিই ছিলেন বাংলায় শেষ আফগান শাসক।
  • দাউদ স্বাধীন সম্রাটের মত ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজ নামে খুৎবা পাঠ করেন ও মুদ্রা জারি করেন।
  • দাউদ কররাণীর আচরণ আকবরকে বাংলা আক্রমণের সুযোগ করে দিল। প্রথমে আকবর জৌনপুরের শাসনকর্তা মুনিম খানকে নির্দেশ দেন কররাণী রাজ্য আক্রমণ করতে।
  • প্রথমদিকে সরাসরি আক্রমণ করেননি মুনিম খান। উজির লোদী খানের পরামর্শে মুনিম খানের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। দাউদ খান উজির লোদীর পরামর্শে মুনিম খানের সাথে ধনরত্ন দিয়ে আপোস করেন। কিন্তু অচিরেই এ অবস্থার পরিবর্তন হয়। দাউদ কিছু ষড়যন্ত্রকারীর পরামর্শে ভুল বোঝেন উজির লোদীকে। দাউদের নির্দেশে হত্যা করা হয় তাঁকে।
  • মুনিম খান লোদীর মৃত্যুর পর ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার থেকে আফগানদের হটিয়ে দেন।
  • মুনিম খান বাংলার দিকে অগ্রসর হন। কররাণীদের বাংলার রাজধানী ছিল তাণ্ডায়। আফগানরা তান্ডা ছেড়ে পিছু হটে। আশ্রয় নেয় হুগলী জেলার সপ্তগ্রামে।
  • রাজধানী অধিকার করে মুঘল সৈন্যরাও অগ্রসর হয় সপ্তগ্রাম-এ। দাউদ খান পালিয়ে যান উড়িষ্যায়।
  • মুনিম খান তান্ডায় মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তান্ডায় পে- রোগ দেখা দিলে মুনিম খানসহ অনেক মুঘল সৈন্য এ রোগে মারা যান।
  • এই সুযোগে দাউদ কররাণী পশ্চিম ও উত্তর বাংলা পুনরায় অধিকার করে নেন। অন্যদিকে ভাটি অঞ্চলের জমিদার ঈসা খান পূর্ব বাংলা থেকে মুঘল সৈন্যদের হটিয়ে দেন। মুঘল সৈন্যরা এবার বাংলা ছেড়ে আশ্রয় নেয় বিহারে।
  • মুনিম খানের মৃত্যু সংবাদ আগ্রায় পৌঁছালে সম্রাট আকবর বাংলার শাসনকর্তা করে পাঠান খান জাহান হুসেন কুলী খানকে। তাঁর সহকারী নিযুক্ত হন রাজা টোডরমল।
  • বাংলায় প্রবেশ পথে রাজমহলে মুঘল সৈন্যদের বাঁধা দেন দাউদ কররাণী। মুঘলদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন বিহারের শাসনকর্তা মুজাফফর খান তুরবাতি।
  • ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের নিকট মুঘল ও আফগানদের মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ হয়। রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ কররাণীর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। পরে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

বার ভূঁইয়াদের ইতিহাস

  • সম্রাট আকবর সমগ্র বাংলার উপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
  • বাংলার বড় বড় জমিদাররা মুঘলদের অধীনতা মেনে নেননি। জমিদারগণ তাঁদের নিজ নিজ জমিদারীতে স্বাধীন ছিলেন।
  • এদের শক্তিশালী সৈন্য ও নৌ-বহর ছিল। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এঁরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
  • বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ ‘বার ভূঁইয়া’ নামে পরিচিত। এ ‘বার’ বলতে বারজনের সংখ্যা বুঝায় না। ধারণা করা হয় অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারদের বোঝাতেই ‘বার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
  • হুসেন শাহী বংশের অবসান হলে ঈসা খানের পিতা সুলায়মান খান সোনারগাঁও অঞ্চলে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন।
  • সোনারগাঁও ও খিজিরপুরের নিকটবর্তী কাত্‌রাবু তাঁর রাজধানী ছিল।
  • দাউদ কররাণীর পতনের পর তিনি সোনারগাঁও-এ রাজধানী স্থাপন করেন।
  • খিজিরপুর দুর্গ ছিল তাঁর শক্তির প্রধান কেন্দ্র।
  • বার ভূঁইয়াদের দমন করার জন্য সম্রাট আকবর ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে শাহবাজ খান, ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাদিক খান, ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে উজির খান ও ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান।
  • তাঁরা ঈসা খাঁন ও অন্যান্য জমিদারের সাথে বহুবার যুদ্ধ করেন। কিন্তু বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খানকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা সম্ভব হয়নি।
  • তিনি সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকারের বিনিময়ে নিজের আধিপত্য বজায় রাখেন। অন্যদিকে তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘মসনদ-ই-আলা’ উপাধি ধারণ করেছিলেন।
  • ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ঈশা খানের মৃত্যু হলে বার ভূঁইয়াদের নেতা হন তাঁর পুত্র মূসা খান।
  • ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহকে দ্বিতীয়বারের মত বাংলায় পাঠানো হয়।
  • ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মূসা খান এক নৌ-যুদ্ধে মানসিংহের হাতে পরাজিত হন। কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করার আগে সম্রাট আকবরের অসুস'তার খবর আসে। সম্রাটের ডাকে মানসিংহ আগ্রায় ফিরে যান।
  • সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সেলিন ‘জাহাঙ্গীর’ নাম ধারণ করে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন।
  • তিনি মানসিংহকে আবার বাংলায় প্রেরণ করেন।
  • এক বছর পর ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবুদ্দীন কোকাকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করা হয়। কুতুবুদ্দীন শের আফকুনের হাতে প্রাণ হারান।
  • তাঁর পরবর্তী সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলীখান এক বছর পর মারা যান।
  • এর পর ইসলাম খান ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গের সুবাদার নিযুক্ত হন।
  • শাসনভার গ্রহণ করেই তিনি বুঝতে পারেন যে, বার ভূঁইয়াদের নেতা মূসা খানকে দমন করতে পারলেই তাঁর পক্ষে অন্যান্য জমিদারদেরকে বশীভূত করা সহজসাধ্য হবে।
  • সেজন্য তিনি রাজমহল হতে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ, মূসা খানের ঘাঁটি সোনারগাঁও ঢাকার অদূরে ছিল। বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় আসার পথে ইসলাম খান বেশ কজন জমিদারের আনুগত্য লাভ করেছিলেন।
  • বার ভূঁইয়াদের মোকাবেলা করার জন্য ইসলাম খান শক্তিশালী নৌ-বহর গড়ে তোলেন।
  • মূসা খানের সাথে প্রথম সংঘর্ষ বাঁধে ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে করতোয়া নদীর পূর্বতীরে যাত্রাপুরে। এখানে মূসা খানের দুর্গ ছিল। যুদ্ধে মূসা খান ও অন্যান্য জমিদার শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন।
  • ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রবেশ করেন। এ সময় থেকে ঢাকা হয় বাংলার রাজধানী। সম্রাটের নাম অনুসারে ঢাকার নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীর নগর’।
  • ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খানের সঙ্গে জমিদারদের যুদ্ধ শুরু হয়। নদীর পূর্ব পাড়ে অবসি'ত মূসা খানের কদম রসুল দুর্গসহ অন্যান্য দুর্গ মুঘলদের অধিকারে আসে। অবস্থার বিপর্যয়ে মূসা খান সোনারগাঁও চলে আসেন।
  • রাজধানী নিরাপদ নয় মনে করে তিনি মেঘনা নদীতে অবসি'ত ইব্রাহিমপুর দ্বীপে আশ্রয় নেন। মুঘল সৈন্যরা সোনারগাঁও অধিকার করে নেন। এর ফলে জমিদারগণ বাধ্য হন আত্মসমর্পণ করতে। কোন উপায় না দেখে মূসা খানও শেষ পর্যন্ত মুঘলদের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। বাংলার বার ভূঁইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে।
  • ইসলাম খান মূসা খানকে অন্যান্য জমিদারদের মতো তাঁকেও তাঁর জমিদারিতে মুঘলদের অধীনস্থ জায়গিরের দায়িত্ব দিলেন।

মুঘল শাসন (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিঃ)

  • সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বার ভূঁইয়াদের দমন করে সমগ্র বাংলায় সুবাদারি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর কাসিম খান চিশতি (১৬১৩ - ১৬১৭ খ্রিঃ) এবং দিল্লির সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ (১৬১৭-১৬২৪খ্রিঃ) বাংলার সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতপর খুব অল্প সময়ের জন্য সুবাদার নিযুক্ত হন দারার খান, মহব্বত খান, মুকাররম খান এবং ফিতাই খান।
  • সম্রাট শাহজাহান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বাংলার সুবাদার হিসেবে কাসিম খান জুয়িনীকে নিয়োগ করেন ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে।
  • হুসেন শাহী যুগ হতেই বাংলায় পর্তুগীজরা বাণিজ্য করত। এ সময় পর্তুগীজ বণিকদের প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়। ক্রমে তা বাংলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কাসিম খান জুয়িনী শক্ত হাতে পর্তুগীজদের দমন করেন।
  • কাসিম খানের পর সুবাদার ইসলাম খান মাসহাদী (১৬৩৫-১৬৩৯ খ্রিঃ) চার বছর শাসন করেন।
  • অতঃপর শাহজাহান তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজাকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। সুজা কুড়ি বছর দায়িত্বে ছিলেন।
  • মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল সুজার শাসনকাল। বিদেশি বণিক গোষ্ঠীর মধ্যে ইংরেজরা এ সময় সুবাদারের কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা লাভ করছিল। এতে বাণিজ্যের পাশাপাশি ইংরেজদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
  • ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর চার পুত্রের প্রত্যেকেই সম্রাট হওয়ার জন্য বিদ্রোহ করে। এ সময় আওরঙ্গজেবের সাথে শাহ সুজার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুই ভাইয়ের যুদ্ধে ১৬৫৯ খিস্টাব্দে শাহ সুজা পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে তিনি আরাকান গমন করেন। সেখানে পরে তিনি সপরিবারে নিহত হন।
  • আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা সুজাকে দমন করার জন্য বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর পর্যন্ত এসেছিলেন। তাই সম্রাট আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে (১৬৬০-১৬৬৩ খ্রিঃ) বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব দেন।
  • অহমদের বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্য তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও কুচবিহার ও আসাম বিজয় মীর জুমলার সামরিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।
  • তাঁর সময়েই কুচবিহার সম্পূর্ণরূপে প্রথমবারের মতো মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। আসাম অভিযানের দ্বারা তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সীমান্ত আসাম পর্যন্ত বর্ধিত করেন।
  • মীর জুমলার মৃত্যুর পর প্রথমে দিলির খান ও পরে দাউদ খান অস্থায়ী সুবাদার হিসেবে বাংলা শাসন করেন। অতপর আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খানকে (১৬৬৪-১৬৮৮ খ্রিঃ) বাংলার সুবাদার নিয়োগ দেওয়া হয়।
  • মাঝখানে ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট তাঁকে দিল্লীতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এরপর ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলার সুবাদার হন।
  • তিনি মগদের উৎপাত হতে বাংলাকে রক্ষা করেন।
  • তিনি সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম অধিকার করে আরাকানী জলদস্যুদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করেন।
  • সুবাদার শায়েস্তা খান কুচবিহার, কামরূপ, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে মুঘল শাসন সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করা হয়।
  • শায়েস্তা খানের শাসনের শেষ দিকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে তাঁর বিরোধ বাঁধে। ইংরেজদের ক্ষমতা এত বৃদ্ধি পেতে থাকে যে তারা ক্রমে এদেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর শায়েস্তা খান বাংলা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন।
  • স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এ যুগকে বাংলায় মুঘলদের ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে অভিহিত করা যায়।
  • তাঁর আমলে নির্মাণ করা স্থাপত্য কার্যের মধ্যে ছোট কাটরা, লালবাগ কেল্লি, বিবি পরীর সমাধি-সৌধ, হোসেনী দালান, সফী খানের মসজিদ, বুড়িগঙ্গার মসজিদ, চকা মসজিদ প্রভৃতি উলে- যোগ্য।
  • শায়েস্তা খানের পর একে একে খান-ই-জাহান বাহাদুর, ইব্রাহিম খান ও আজিমুদ্দিন বাংলার সুবাদার হন। তাঁদের সময় বাংলার ইতিহাস তেমন ঘটনাবহুল ছিলনা।
  • দক্ষ সুবাদার হিসাবে এবার বাংলার ক্ষমতায় আসেন মুর্শিদ কুলী খান (১৭০০-১৭২৭ খ্রিঃ)।
  • প্রথমে তাঁকে বাংলার দিউয়ান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দিউয়ানের কাজ ছিল সুবার রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা।
  • সম্রাট ফখরুখ শিয়ারের রাজত্বকালে মুর্শিদ কুলী খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন।
  • সম্রাট আওঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দুর্বল মুঘল সম্রাটগণ দূরবর্তী সুবাগুলোর দিকে তেমন দৃষ্টি দিতে পারেননি। ফলে এসব অঞ্চলের সুবাদারগণ অনেকটা স্বাধীনভাবে নিজেদের অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। মুর্শিদ কুলী খানও অনেকটা স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি নামমাত্র সম্রাটের আনুগত্য প্রকাশ করতেন এবং বার্ষিক ১ কোটি ৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব পাঠাতেন।
  • এ সময় সুবাকে বলা হতো ‘নিজামত’ আর সুবাদারের বদলে পদবী হয় ‘নাজিম’।
  • রাজস্ব সংস্কার মুর্শিদ কুলী খানের সর্বাধিক স্মরণীয় কীর্তি। তিনি ভূমি জরিপ করে রায়তদের সামর্থ্য অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করেছিলেন।
  • নাজিম পদটি হয়ে পড়ে বংশগত। সুবাদার বা নাজিমগণ বাংলার সিংহাসনে বসে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে শুধু একটি অনুমোদন নিয়ে নিতেন। স্বাধীন শাসকগণ পরিচিত হন ‘নবাব’ হিসেবে।
  • মুর্শিদ কুলী খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। তাই তাঁর কন্যা জিনাত-উন-নিসার স্বামী সুজাউদ্দিন খানকে (১৭২৭- ১৭৩৯ খ্রিঃ) সম্রাট ফররুখ শিয়ার বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। সুজাউদ্দিন একজন স্বাধীন নবাবের মর্যাদা নিয়ে সিংহাসনে বসেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা- তিন প্রদেশেরই নবাব হয়েছিলেন তিনি।
  • সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হন। তাঁর অযোগ্যতার কারণে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ সুযোগে বিহারের নায়েব-ই-নাজিম আলীবর্দী খান সরফরাজকে আক্রমণ করেন। সরফরাজ পরাজিত ও নিহত হন।
  • মুঘল সম্রাটের অনুমোদনে নয়, বাহুবলে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন আলীবর্দী খান। আলীবর্দীর শাসনকালে (১৭৪০-১৭৫৬ খ্রি:) বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • আলীবর্দী খান ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০ বছর প্রতিরোধ করে বর্গীদের দেশ ছাড়া করতে সক্ষম হন।
  • তাঁর শাসনকালে আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করলে তিনি শক্ত হাতে তা দমন করেন।
  • আলীবর্দী খান তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
  • আলীবর্দীর প্রথম কন্যা ঘষেটি বেগমের ইচ্ছে ছিল তাঁর দ্বিতীয় ভগ্নির পুত্র শওকত জঙ্গ নবাব হবেন।
  • ফলে তিনি সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। কয়েকজন অভিজাতের সমর্থন লাভ করেন ঘষেটি বেগম। এদের মধ্যে রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফর, উমিচাঁদ, রাজবল্লি প্রমুখের নাম করা যায়।
  • প্রাসাদের ভেতর এ ষড়যন্ত্রকে কাজে লাগায় বাংলায় বাণিজ্য করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুচতুর ইংরেজ বণিকরা।
  • ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন।